ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘এটা জরুরি প্রয়োজনে নিতে হয়েছিল। যদি আমি সেখানে থাকতাম, তাহলে শুধু আমার নয়, চারপাশের সবার জীবন বিপদে পড়ত।’ গতকাল ভারতীয় দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
একই দিন ভারতীয় দৈনিক ‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ এবং ‘হিন্দুস্তান টাইমসে’ সাক্ষাৎকার এবং সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘দ্য উইক’-এ তাঁর নামে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকার তিনটি ইমেইলে নেওয়া। এসব সাক্ষাৎকার ও নিবন্ধে তিনি আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, তাঁর শাসনামলে অর্থ পাচার, অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ, জুলাই সনদ, সংবিধান সংস্কার, গণভোট, বিএনপি ও উগ্রপন্থার উত্থান বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন।
শেখ হাসিনার কাছে দ্য হিন্দুর প্রশ্ন ছিল, দেশ ছাড়ার আগে আপনি কি পদত্যাগ করেছিলেন? যদি করে থাকেন, তাহলে ঢাকায় কারও কাছে কি আপনার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন? বিস্তারিত বলবেন কি?
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে হলে রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি জমা দিতে হয়। আমি কখনোই এমন কোনো চিঠিতে সই করিনি, বা রাষ্ট্রপতিও তা গ্রহণ করেননি।’
এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘ঢাকা ত্যাগ করাটা আমার কাছে সহজ কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং এটা ছিল জরুরি প্রয়োজনে নেওয়া। স্পষ্ট হয়েছিল, যদি আমি সেখানে থাকি, তবে শুধু আমার নয়, চারপাশের সবার জীবন বিপদে পড়বে। নিরাপত্তার পরিবেশ ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল। আমার, পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীদের জীবনের ওপর হুমকি ছিল।’
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রশ্ন ছিল, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আপনার সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে অন্তর্বর্তী সরকার অভিযোগ এনেছে। জাতিসংঘ বলেছে, এই বিক্ষোভে প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এই অভিযোগগুলোর জবাবে আপনি কী বলবেন?
এর উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অভিযোগ করা হয়েছে, এই প্রাণহানির সঙ্গে যুক্ত নিরাপত্তা পদক্ষেপ ছিল আমার– এর কোনো ভিত্তি নেই। অভিযোগগুলোর উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করা। মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর পদক্ষেপকে সরকারের সরাসরি নির্দেশ হিসেবে চিহ্নিত করাটা ভুল। সহিংসতা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্যের ভুল ছিল। তবে আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রতি মুহূর্তের কৌশলগত পদক্ষেপে নির্দেশ দিচ্ছিলাম– এ ধারণাটি নিরাপত্তা বাহিনী কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে মৌলিকভাবে ভুল করা। আমি আবারও বলছি, কোনো অবস্থাতেই আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর অনুমতি দিইনি।’
দ্য উইকের নিবন্ধে শেখ হাসিনা দেশে ‘গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে ‘অভিজাত শ্রেণি’র শাসন চলছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের সাক্ষাৎকারে চরমপন্থার উত্থান নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বর্তমান সরকারের নীতির কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তিনি সতর্ক করেছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন করার কথা ভাবা হচ্ছে, তা বৈধতা পাবে না।
ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসে সাক্ষাৎকারে তিনি নয়াদিল্লির প্রতি তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি ভারতীয় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। দ্য হিন্দুতে বিএনপির সঙ্গে কোনো গোপন বোঝাপড়ার সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতোই বিএনপিও একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। তারা বর্তমান সরকারের অসংগতিগুলো তুলে ধরছে।’
‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’র প্রশ্ন ছিল– সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, আপনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার লুট হয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম বিদেশে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগ করেছে, আপনি পরিবার বা নেতাদের সুবিধা দিতে বেআইনিভাবে সরকারি জমি বরাদ্দ দিয়েছেন। এখন আপনার, ছেলে এবং মেয়ের বিরুদ্ধে আদালতের বিচার চলছে। নিজের, পরিবার এবং রাজনৈতিক সহকর্মীদের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির অভিযোগগুলোর জবাবে কী বলবেন?
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এগুলো তৈরি করেছে। আমি অস্বীকার করছি না যে দুর্নীতি ছিল না, তবে কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে আমার পরিবার ও সহযোগীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন বা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের কথা ভিত্তিহীন এবং হাস্যকর। এত বড় অঙ্কের চুরি করা সম্ভব নয়। যদি এমনটি ঘটত, তবে আমাদের অর্থনীতি ধসে পড়ত। অভিযোগকারীরা তথ্যের চেয়ে কাল্পনিক অভিযোগকে বেশি পছন্দ করেন।’

0 coment rios: